মরিচগাছের পাতা কোকড়ানো রোগের প্রতিকার
মরিচের রোগ প্রতিরোধের উপায়?প্রিয় বন্ধুরা মরিচ গাছের পাতা কোকড়ানো রোগের প্রতিকার নিয়ে কম-বেশি সবাই অনেক চিন্তিত এবং অনেক খোঁজাখুঁজি করেন কিন্তু সঠিক ভাবে কথাও এর সমাধান খুঁজে পান না। এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা মরিচ গাছের পাতা কোঁকড়ানো রোগের সমস্যার সমাধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়লে আপনারা সমস্যার সমাধান পাবেন।
নিচে এই আর্টিকেলের মাধ্যমে মরিচ গাছের পাতা কোকড়ানো রোগের প্রতিকার, মরিচ গাছ কত প্রকার,মরিচের চারা রোপন পদ্ধতি ও আরো অন্যান্য পয়েন্ট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
ভূমিকাঃ
আমাদের নিত্য দিনের খাদ্য তালিকায় মরিচের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিদিন রান্নার কাজে কাঁচা পাকা কাঁচা ও পাকা উভয় মরিচের আমাদের প্রয়োজন হয়। মরিচের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ ও সি থাকে যা আমাদের শরীরের জন্য খুবই দরকারি। তাছাড়া মরিচ আমাদের খাবারের স্বাদকে বাড়িয়ে দেয় অনেকাংশে।
কিন্তু মরিচের অনেক ধরনের রোগ হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে যে রোগটি বেশি দেখা যায় সেটি হল মরিচের পাতা কোকড়ানো রোগ। এই রোগ হলে মরিচের ফল, ফুল এবং উৎপাদন কমে যায় এমনকি সময় মত পরিচর্যা না করলে গাছ মরে পর্যন্ত যায়।
আর এসব সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে হলে জানতে হবে মরিচ গাছের পাতা কোঁকড়ানো রোগের লক্ষণ, পাতা কখনো রোগের প্রতিকার ইত্যাদি সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে।
মরিচ কত প্রকার?
আমাদের দেশে মূলত মসলা হিসেবে পরিচিত। কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থায় মরিচের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কাঁচামরিচের প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ ওসি রয়েছে। প্রতিদিনের রান্নার রং রুচি ও স্বাদের ভিন্নতা আনার জন্য মরিচ একটি অপরিহার্য উপাদান। মরিচের কিছু উন্নত জাত হলোঃ বারি মরিচ-১, বারি মরিচ-২ এবং বারি মরিচ-৩।
বারি মরিচ-১ সারা বছর চাষ করা যায়। বারি মরিচ-২ গ্রীষ্মকালীন এবং বারি মরিচ-৩ শীতকালীন চাষ উপযোগী। এছাড়াও সনিক, প্রিমিয়াম, ধুম, মেজর, ডেমন, চন্দ্রমুখী, হটমাস্টার, এমএস ফায়ার, যমুনা প্রভৃতি জাত রয়েছে।
মরিচের চারা রোপন পদ্ধতিঃ
জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে ও আগাছা বাছাই করে ৩.১ মিটার আকারের বীজতলা করে সেখানে বীজ বপন করা হয়। শীতকালের জন্য ভাদ্র- আশ্বিন মাসে ও বর্ষা মৌসুমের জন্য ফাল্গুন- চৈত্র মাসে বীজতলায় বীজ বপন করা হয়। চারা ১০ সে.মি. উঁচু হলে রোপনের উপযোগী হয়।
এরপর আগাছা পরিষ্কার করে ৪-৫ টি চাষ ও মই দিয়ে জমি প্রস্তুতির পর চারা রোপন করা হয়। চারা রোপণে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০-৭০সে.মি. ও চারা থেকে চারার দূরত্ব ৩০-৪০ সে.মি. রাখা হয়। চারা বিকেলে লাগাতে হবে এবং ২-৩ দিন সকা- বিকাল পানি দিতে হবে।
মরিচ গাছের বৈশিষ্ট্যঃ
আমরা কম বেশি সবাই মরিচ খাই, কিন্তু কখনো কি কেউ মরিচ সম্পর্কে কিছু জানতে চেয়েছি? আসুন মরিচের কিছু বৈশিষ্ট্য জেনে নিন-
- মরিচ একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ।
- মরিচের প্রধান মূল তন্ত্র আছে।
- মরিচের কান্ড, শাখা- প্রশাখা, পাতা, ফুল ও ফল রয়েছে।
- মরিচ গাছের শাখা-প্রশাখা বহুল এবং ঝোপের ন্যায়।
- পত্রবিন্যাস একান্তর, পত্রবৃন্ত ছোট এবং বড় দুই রকমের হয়।
- ঝাল মরিচের পত্রকক্ষে দুই বা ততোধিক ফুল পাওয়া যায়।
- দলমন্ডলে পাঁচটি সাদা পাপড়ি যুক্ত থাকে এবং দেখতে চোঙের মত।
- পুংস্তবকে পাঁচটি পুংকেশর থাকে।
- পরাগধানী কালো বা গাঢ় বেগুনি রঙের
- গর্ভাশয়ে দুইটি প্রকোষ্ঠ অনেক ডিম্বক থাকে।
- মরিচ গাছে স্বপরাগায়নও ঘটে।
- মরিচে ক্যাপসিনিন নামক ফেনিল জাতীয় পদার্থে প্রচুর দারুন ঝাল থাকে।
- মিঠা মরিচে ক্যাপসিনিন কম থাকে বলে ঝাল কম হয়।
- মিঠা ও ঝাল মরিচের প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি এবং অল্প পরিমাণে ভিটামিন এ এবং ই থাকে।
মরিচের পাতা কোকড়ানো রোগের লক্ষণঃ
মরিচের পাতা কোকড়ানো রোগের অন্যতম লক্ষণ হল মাকড় বা পোকা। এই মাকড়ের আক্রমণে মরিচের পাতা কুঁকড়ে যায়। এটি ভাইরাসের মতো কিন্তু ভাইরাস নয়। অনেকেই মনে করেন ভাইরাসের কারণে হয়তো এরকম হয়েছে। আসলে কিন্তু ভাইরাস নয়।
কচি পাতার রস এই থ্রিপস পোকা গাছের কচি পাতা ও ডগার রস শুষে খেয়ে ফেলে ফলে পাতা উপরের দিকে কুঁকড়ে যায় এবং গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। পাতার মধ্যশিরায় আশে-পাশে বাদামী রং হয়ে যায় ও শুকিয়ে যায়।
নতুন বা পুরানো পাতার নিচের পিঠে অনেক ক্ষতি হয় যার ফলে নৌকার খোলের মতো করে পাতা উপরের দিকে কুঁকড়ে যায়। আক্রান্ত পাতা দেখতে বিকৃত দেখায়।
মরিচ গাছের পাতা কুঁকড়ে যাওয়ার কারণঃ
মরিচ কিংবা যে কোন গাছে পাতার কোকড়ানো বিভিন্ন সমস্যা থেকে তৈরি হয়। বিভিন্ন কীটপতঙ্গ ভাইরাস এবং পরিবেশগত সমস্যায় এর প্রধান কারণ। পাতা কুঁকড়ে যায় প্রধানত তিনটি মারাত্মক পোকার আক্রমণে-
- থ্রিপস পোকা
- মাকড়
- সাদামাছি
এই কীটগুলোর খাওয়ার কার্যক্রমের জন্য পাতা কুঁকড়ে যায়। প্রাপ্তবয়স্ক পাতার ওপর স্পষ্ট দাগ দেখা যায় পরে পাতা শুকিয়ে বা ঝড়ে পরে যায়। তবে খাদ্যের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে অনেক সময় কচি বাড়ন্ত পাতা কুঁকড়ে যায় যায়।
মরিচ গাছের পাতা কোকড়ানো রোগের প্রতিকারঃ
মরিচের পাতা কুঁকড়িয়ে যাওয়া রোগ একটি সাধারণ রোগ। মরিচের উৎপাদন ব্যহত হওয়ার অন্যতম কারণ হলো মরিচের পাতা কোঁকড়ানো রোগ। মরিচের পাতা কোকড়ানো রোগের প্রতিকার তুলে ধরা হলো-
- রোগাক্রান্ত গাছ ও আশেপাশের পোষক উদ্ভিদ তুলে ধ্বংস করতে হবে।
- রোগাক্রান্ত গাছ কোন অবস্থাতেই লাগানো যাবে না এবং যদি সম্ভব হয় চারা অবস্থায় বীজতলা মশারির নেট দ্বারা ঢেকে রাখতে হবে।
- সুস্থ গাছ থেকে পরবর্তী মৌসুমের জন্য বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
- যারা অবস্থা থেকে কীটনাশক সাকসেস ২.৫% এস সি অথবা এমবেকটিন ১.৮ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি ভালো করে মিশিয়ে বাহক পোকা দমনের জন্য স্প্রে করতে হবে।
- প্রথমবার স্প্রে করার ৩-৫ দিন পর পুনরায় স্প্রে করতে হবে। পাতার নিচের পিঠ সহ পুরো গাছে স্প্রে করতে হবে। যাতে পাতা ও গাছ ভিজে যায়। তবে মাইট আক্রমণের পূর্বেই ইকোম্যাক (বায়ো মাইটিসাইড) ১৫ দিন পর পর স্প্রে করলে ভালো হয়।
মরিচ গাছের পাতা কোকড়ানো রোগের ঘরোয়া প্রতিকারঃ
মরিচ গাছে বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে এর মধ্যে পাতা কুঁকড়ে যাওয়া রোগ অন্যতম। মরিচ গাছের পাতা কুঁকড়ে গেলে গাছের বৃদ্ধি কমে যাবে। ফুল ফল কমে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত গাছ মরে যাবে। মরিচ গাছের পাতা কুঁকরিয়ে যাওয়ার সমস্যা দূর করার কিছু ঘরোয়া সমাধান নিচে আলোচনা করা হলো-
প্রথমে এক কাপ পানিতে এক চামচ ডিটারজেন্ট পাউডার ও এক চামচ গুল মিশিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে স্প্রে বোতলে বোতলে করে নিয়মিত পুরো গাছে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। এভাবে কিছুদিন স্প্রে করলে দেখবেন গাছের কোকড়ানো সমস্যা চলে গেছে এবং গাছের মধ্যে যত ছোট ছোট পোকা ছিল সব মরে গেছে। গাছের কোকড়ানো সমস্যা চলে গেছে সাথে সাথে নতুন পাতা গজিয়েছে।
১ লিটার পানির মধ্যে এক চা চামচ ডিটারজেন্ট দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। তারপর এর মধ্যে হাফ চা চামচ থিওভিট যোগ করে নিতে হবে। পরিমাণ মতো থিওভিট দিতে হবে তা না হলে গাছের পাতা পুড়ে যাবে। পরিমাণ মতো থিওভিট দেয়ার পর মিশ্রণটি ভালোভাবে নেড়ে মিশিয়ে নিতে হবে। তারপর মিশ্রণটি একটি স্প্রে বোতলের মধ্যে ঢুকিয়ে গাছের মধ্যে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। এভাবে কয়েকদিন নিয়মিত স্প্রে করলে গাছের পাতা কোকড়ানো সমস্যার সমাধান হবে।
মরিচ গাছের পাতা কোকড়ানো ওষুধঃ
মরিচের পাতা কোকড়ানো রোগ মাইট/মাকড় ও ভাইরাসের জন্য হয়। পোকা ও মাকড় নাশক ভারটিমেক ঔষধ প্রতি এক লিটার পানিতে ১মি.গ্রাম হারে মিশিয়ে এবং এর সাথে যে কোন কোম্পানির ডিটারজেন্ট ১ চামচ ভালো করে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
অনেকেই মনে করেন ওষুধের সাথে ডিটারজেন্ট কেন ব্যবহার করব? ভারটিমেক ব্যবহার করলে পোকা ও মাকড় মারা যায় কিন্তু পোকামাকড়ের ডিম গুলো থেকে যায় মরিচের পাতায় আর সেই ডিমগুলো আবার বাচ্চা হয়ে বের হবে আর মরিচের ক্ষতি করবে।
আবার তাই ডিটারজেন্ট ব্যবহার করব পোকাও মাকর নাশক ওষুধের সাথে মরিচের পাতা কোকড়ানো রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পাইমেট্রোজিন ও নিতেনপাইরাস গ্রুপের ব্যবহার করলে অনেক অংশে আটকানো যায় তবে সবচেয়ে ভালো কাজ করে থাকে এ দুটির মিক্স করে ব্যবহার করলে।
এটি ব্যবহারের মাত্রা হল প্রতি লিটার পানিত ১ গ্রাম করে ভালো করে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে আক্রান্ত গাছে। এগুলো ছাড়াও কিছু প্রাথমিক উপায় রয়েছে তা হলো-
- ভালো চারা থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
- রোগাক্রান্ত চারা রোপন করা যাবে না।
- রোগাক্রান্ত চারার আশেপাশে পোষক উদ্ভিদ তুলে ফেলতে হবে।
- যে গাছের রোগ দেখা দিয়েছে সেই গাছ তুলে ফেলতে হবে।
- যদি শতকরা দুইটি গাছে রোগ দেখা দেয় তাহলে দুইটি গাছই তুলে ফেলে দিতে হবে।
- আর যদি বেশি দেখা দেয় তাহলে উপরে দেওয়া কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
পরিশেষেঃ
মরিচের অনেকগুলো রোগ রয়েছে যেগুলো সাধারণত চারা রোপনের ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে শুরু হয়ে যায়। মরিচের পাতা কোকড়ানো রোগ হয়ে থাকে সাধারণত বিভিন্ন ধরনের পোকা ও মাকড়ের আক্রমণের কারণে।
কৃষি গবেষকদের মতে, মরিচের পাতা কোকড়ানো রোগের কারণে মরিচের প্রায় ৬০% থেকে ৭০% উৎপাদন কমে যায়। তাই এই আর্টিকেল এর মাধ্যমে আমরা মরিচের পাতা কোকড়ানো রোগের লক্ষণ, প্রতিকার, ঘরোয়া চিকিৎসা এবং চারা রোপনের পদ্ধতি সম্পর্কে খুঁটিনাটি বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
আশা করি আর্টিকেলটি যদি আপনি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়েন তাহলে মরিচের পাতা কোকড়ানো রোগের প্রতিকার সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে পারবেন এবং আপনার অনেক উপকারে আসবে। তাই আর্টিকেলটি পড়ে যদি আপনি উপকৃত হয়ে থাকেন তাহলে আপনার পরিচিত বন্ধু- বান্ধবের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না।
সাফান বিডির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url