চুই ঝাল কি? এর চাষ পদ্ধতি এবং ঔষধি গুণ সম্পর্কে জানুন
চুই ঝাল রান্নার নিয়মহ্যালো বন্ধুরা, চুই ঝাল কি? এর চাষ পদ্ধতি এবং ঔষধি গুণ আপনাদের অনেকের অজানা। আপনারা কি জানতে চান চুই ঝাল সম্পর্কে। তাই আজকে আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা আপনাদেরকে চুইঝাল কি? এবং চুই ঝাল সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য বিস্তারিত আলোচনা করতে যাচ্ছি।
নিচে আর্টিকেলে আমরা চুই ঝাল কি? চুই ঝালের ব্যবহার, চুই ঝাল চাষ পদ্ধতি এবং চুই ঝাল খাওয়ার নিয়মসহ আরও অন্যান্য পয়েন্ট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
ভূমিকাঃ
চুই ঝাল অত্যন্ত সুস্বাদু এবং ঝাল প্রকৃতির ঔষধি গুনসম্পন্ন মসলা। এই চুই ঝাল যে কোন খাবারকে সুস্বাদু করে এবং খাবারের স্বাদকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে তোলে। তাছাড়া চুঁই ঝালের মধ্যে প্রচুর ঔষধি গুন আছে যা আমাদের বিভিন্ন ধরনের রোগ নিরাময়ে সাহায্য করে। তাছাড়া দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছে চুই ঝাল একটি জনপ্রিয় খাবার।
তারা মাছ মাংস সহ অন্যান্য খাবারেও এই চুই ঝাল ব্যবহার করে থাকে। এজন্য দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ব্যাপকভাবে এই চুই ঝাল চাষ করা হয়। তাই আজকে আর্টিকেলের মাধ্যমে আপনাদেরকে জানিয়েছি চুই ঝাল খাওয়ার নিয়ম ও চুই ঝালের ব্যবহার সম্পর্কে।
চুইঝাল কি?
চুই ঝাল বা চই ঝাল (বৈজ্ঞানিক নাম: Piper chaba) হচ্ছে পিপারাসি পরিবারের সম্পূরক লতা. পান ও চুইঝাল একই পরিবারের। চুই ঝাল গাছ দেখতে পানের লতার মতো। পাতা কিছুটা লম্বা ও পুরু। পাতায় ঝাল নেই। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিশেষ করে খুলনা বিভাগের রান্নায় চুই ঝালের ব্যবহার ব্যাপক।
এর কান্ড বা লতা কেটে ছোট ছোট টুকরো করে মূলত মাংস রান্নায় ব্যবহার করা হয়। রান্নার পর এই টুকরোগুলো চুষে বা চিবিয়ে খাওয়া হয়। ঝাল স্বাদের এই চুয়ে রয়েছে নিজস্ব আলাদা স্বাদ ও ঘ্রাণ।
চুই ঝালের ব্যবহারঃ
গাছটির কান্ড বা লতা মসলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। খুলনা অঞ্চলে চুই ঝালকে মসলা হিসেবে ব্যবহার করে মাংসের সাথে রান্না করা হয়। রান্নায় এর ঝাল খাবারের স্বাদ বাড়ায় আবার শরীরেরও কোন ক্ষতি করে না। ঝোল জাতীয় মাছ-মাংস সবকিছুতেই এটি স্বাদ বাড়িয়ে দেয়।
এদের কান্ড শিকড় পাতা ফুল ও ফলে ঔষধি গুণ আছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা খুলনা, যশোর ,সাতক্ষীরা, বাগেরহাট এবং নড়াইল এলাকায় এই চুইঝাল মসলা হিসেবে খুব জনপ্রিয়।
চুই ঝাল খাওয়ার নিয়মঃ
চুই ঝাল মজাদার একটি খাবার। বেশিরভাগ চুই ঝাল মাংসের সাথে রান্না করে খাওয়া হয়। মাংস ছাড়াও অনেক বড় মাছ ,খিচুড়ি, ডাল ইত্যাদি তরকারিতেও চুই ঝাল ব্যবহার করা হয়। মোটকথা ভারী পাকের প্রায় সব ধরনের তরকারিতে চুই ঝাল রান্না করে খাওয়া যায় । তরকারিতে চুই ঝালের ডাটা ছোট ছোট করে কেটে দেওয়া হয়।
তারপর খাবারের সময় সেই ডাটাগুলোকে চিবিয়ে খেতে হয়। দেশি চুই ঝালের আঠালো স্বাদের ঝাঁঝালো স্বাদে বিমোহিত হবে যে কেউ। তবে চুয়ের শিকড়ের মধ্যে কাণ্ডের তুলনায় করা সুঘ্রাণ ও ঝাঁঝালো স্বাদ বেশি থাকার কারণে এটি কাণ্ডের তুলনায় বেশি ব্যবহৃত হয়। এটি দেশের দক্ষিণ পশ্চিমের অঞ্চলের অনেক বিখ্যাত খাবার হিসেবে পরিচিত।
চুই ঝাল এর ছাল বাকল পলিথিনে মুড়ে ডিপ ফ্রিজে রেখে দীর্ঘ সময় ধরে খাওয়া যায়। বাসায় ফ্রিজ না থাকলে চটের বস্তায় মুড়ে মাঝে মাঝে পানি ছিটা দিয়ে খাওয়া যায় বা ওয়াটার প্রুফ বক্সের মধ্যে রেখেও দীর্ঘ সময় ধরে খাওয়া যায়।
চুই ঝালের চাষ পদ্ধতিঃ
চুই ঝালের বীজ ও লতার কাটিং দিয়ে বংশবিস্তার করা যায়। তবে লতার কাটিংয়ে তাড়াতাড়ি গাছ বাড়ে এবং ফলন দ্রুত পাওয়া যায়। বীজ থেকে বংশবিস্তার জটিল। তাছাড়া বীজ থেকে বংশবিস্তার সময় সাপেক্ষ বলে আমাদের দেশে শুধু লতা থেকে বংশ বিস্তার করা হয়। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সব কয়টি নার্সারিতে চুই ঝালের চারা পাওয়া যায়।
জমি ও মাটিঃ দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি এবং পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত ও ছায়াময় উঁচু জমিতে সাধারণত চুই চাষ করা হয়। চুই ঝালের জন্য আলাদা কোন মাটি জমির প্রয়োজন নেই সাধারণত ফলবাগান বা বৃক্ষ বাগানের মাটিই চুয়ের জন্য উপযুক্ত। শুধু খেয়াল রাখতে হবে বর্ষায় বা বন্যা যেন চুইঝাল গাছের গোড়ায় পানি না জমে থাকে।
রোপনের সময়ঃ বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ (এপ্রি -মে) এবং আশ্বিন- কার্তিক (অক্টোবর- নভেম্বর) মাস এ দুইবার হলো দুই ঝালের লতা রোপনের উপযুক্ত সময়। অঙ্গজ প্রজনন বা লতা কাটিং পদ্ধতিতে এর কান্ড বা শাখা ৫০ থেকে ৭৫ সেন্টিমিটার লম্বা করে কেটে সরাসরি মাটিতে রোপন করা হয়।
স্থানীয়ভাবে কাটিং বা শাখাকে পোড় বলে। একটি পোড়ে কমপক্ষে ৪- ৫ টি পর্বসন্ধি থাকে বাণিজ্যিকভাবে পলিব্যাগ চারা তৈরি করা হয়। তারপর পলিব্যাগ থেকে চারা নিয়ে মূল জমিতে রোপন করা হয়।
কাটিং শোধনঃ ভালো বালাই মুক্ত আবাদের জন্য চুই ঝালের কাটিং তৈরি ছাড়া গোপনের আগে অবশ্যই রোপনের আগে অবশ্যই শোধন করে নিতে হবে। এক লিটার পানিত ২-৩ গ্রাম প্রোভেক্স/নোইন/ ব্যাভিস্টিন বা অন্য কোন উপযুক্ত রাসায়নিক মিশিয়ে কাটিং ৩০ মিনিট চুবিয়ে রাখার পর পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলে কাটিং রোপন করতে হবে। এতে করে রোগ পোকার আক্রমণ হয় না বা অনেক কম হয়। লতা ভালোভাবে বেড়ে ওঠে।
স্যার ও সেচ ব্যবস্থাঃ চুই চাষে চাষিরা সাধারণত কোন রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন না। পোড় বা শাখা রোপনের আগে গর্তে পচা আবর্জনা বা ছাই বা গোবর ব্যবহার করেন। তবে কেউ কেউ কোথাও কোথাও কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী সাধারণ হারে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি বর্ষার আগে ও পরে গাছের গোড়া থেকে ১ হাত দূরে প্রয়োগ করেন।
শুকনো মৌসুমে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। অন্তত সপ্তাহে একবার কাছের গোড়ায় সেচ দিলে গাছ তাড়াতাড়ি বাড়ে। আর বর্ষাকালে সুইসাইনের ঘোড়া যেতে পারি না যাবে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
বাউনি দেয়াঃ আম, জাম, কাঁঠাল, সুপারি, নারিকেল, দেবদারু, নিম, মেহগনি প্রভৃতি গাছে চই লতিয়ে বাড়তে পারে। চুই গাছ একবার কোন গাছকে আঁকড়ে ধরলে তাকে ঝড়েও আর সরাতে পারে না। এজন্য কোন ফলের গাছে চুইঝালের গাছ তুলে দেওয়া উচিত না।
এতে সে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন কমে যায়। আম ও জিকা/ কেচা গাছে তুলে দিলে ভালো ফলন দেয়। বাউনি ছাড়াও চুই হয়। সে ক্ষেত্রে মাটিতেই চুই গাছের ঝোপ হয়। তাকে বলে আইটে চুই।
ফল সংগ্রহ ও ফলনঃ চুই লাগানোর বা রোপণের ১ বছরের মাথায় খাবার উপযোগী হয়। তবে ভালো ফলনের জন্য ৫-৬ বছর বয়সের গাছে উত্তম। সে মতে ৪- ৫ বছর অপেক্ষা করা ভালো। হেক্টর প্রতি ২.০ থেকে ২.৫ মেট্রিক টন ফলন পাওয়া যায়। ৫-৬ বছরের একটি গাছ থেকে বছরে প্রায় ১৫ থেকে ২৫ কেজি পর্যন্ত চুই ঝাল লতার ফলন পাওয়া যায়।
চুই ঝালের ঔষধি গুন বা উপকারিতাঃ
চুই ঝালের রান্না শুধু সুস্বাদুই নয় বরং এ রয়েছে প্রচুর ঔষধি গুণ। তবে আসুন জেনে নেওয়া যাক চুই ঝালের বেশ কিছু ঔষধিগুণ।
- চুই ঝাল গ্যাস্ট্রিক সমস্যার সমাধান করে ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
- চুই ঝাল হৃদরোগের সমস্যা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- খাবারের রুচি বাড়াতে এবং ক্ষুধামন্দা দূর করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
- চুই ঝাল ক্যান্সার প্রতিরোধ সাহায্য করে।
- পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহ সারাতে চুই ঝাল অনেক উপকারী।
- স্নায়বিক উত্তেজনা ও মানসিক অস্থিরতা প্রশমন করে।
- অ্যাজমা ও ব্রঙ্কাইটিস রোগের ঔষধ হিসেবে কাজ করে চুই ঝাল। ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক জনিত রোগ প্রতিরোধে চুই ঝাল বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাজনিত রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- ঘুমের ঔষধ হিসেবে কাজ করে এবং শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে এবং শরীরের ব্যথা সারায়।
- সদ্য প্রসূতি মায়েদের শরীরের ব্যথা দ্রুত কমাতে ম্যাজিকের মতো কাজ করে।
- কাশি কফ হাঁপানি শ্বাসকষ্ট ডায়রিয়া ও রক্তস্বল্পতা দূর করে।
- এক ইঞ্চি পরিমাণ চুই লতার সাথে আদা পিষে খেলে সর্দির সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
চুই ঝালের দামঃ
প্রকারভেদে চুই ঝালের দামে ভিন্নতা রয়েছে। আকার ভেদে খুলনার দেশে চুই ঝালের দাম ৪০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা হয়। চুই ঝালের কান্ড যত বেশি মোটা হবে দাম তত বেশি হয়। সবচেয়ে বেশি সুস্বাদু অংশ হলো শিকড়ের অংশ। একে এটো চুই ঝালও বলা হয়।
মন্তব্যঃ
চুই ঝালের স্বাদ যেহেতু ঝাল সেহেতু এটি তরকারিতে মরিচের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া এর মধ্যে প্রচুর ঔষধি গুণ রয়েছে বিশেষ করে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার সমাধানে এটি খুব সাহায্য করে।তাই আমরা নিঃসন্দেহে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় চুই ঝাল রাখতে পারি।
উক্ত আর্টিকেলে চুল ঝালের ব্যবহার ও ঔষধিগুণ সহ অন্যান্য তথ্য জানতে পেরেছেন এবং উপকৃত হয়েছে। তাই আর্টিকেলটি পরে যদি আপনারা উপকৃত হয়ে থাকেন তাহলে আপনাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করবেন যাতে অন্যরা পড়ার সুযোগ পায়।
এতক্ষণ ধরে পুরো আর্টিকেল জুড়ে আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য ধন্যবাদ এবং নিত্য নতুন পোস্ট পেতে আমাদের www.safanbd.com ওয়েব সাইটটি ভিজিট করবেন।
সাফান বিডির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url