ডিভোর্স কি এবং কিভাবে কোর্টের মাধ্যমে ডিভোর্স দিতে হয় জানুন
স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়ার নিয়মহ্যালো বন্ধুগণ, নিশ্চয়ই আপনাদের সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তাই আপনারা চান ডিভোর্স দিতে। কিন্তু কোর্টের মাধ্যমে কিভাবে ডিভোর্স দিতে হয় সে বিষয়ে আপনাদের তেমন কোনো জানাশোনা নেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করার পরও আসল তথ্য খুঁজে পান নি।
তাই আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা আপনাদেরকে জানাতে যাচ্ছি কিভাবে কোর্টের মাধ্যমে ডিভোর্স দিতে হয় সে বিষয়ে। তাই আর্টিকেলটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়লে ডিভোর্স দেওয়া নিয়ে আপনাদের মধ্যে আর কোন সমস্যা থাকবে না।
নিচে আর্টিকেলে আমরা ডিভোর্স কি, ডিভোর্সের ধরন সমূহ এবং কোর্টের মাধ্যমে ডিভোর্স সহ আরও অন্যান্য পয়েন্ট নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি।
ভূমিকাঃ
বর্তমানে কম বেশি প্রতিটি সংসারে দাম্পত্য কলহ দেখা দিচ্ছে। আর এই দাম্পত্য কলহ থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই বেছে নেন ডিভোর্সের পথ। আর এই ডিভোর্স একটা পুরো সংসারকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।ডিভোর্সে নানা ধরনের ঝামেলা ও জটিলতা রয়েছে।
আমাদের সমাজে এমন অনেক লোক আছে যারা ডিভোর্স সম্পর্কে কিছুই জানেনা। কিভাবে ডিভোর্স দিতে হয় এবং কি কি জানতে হয় ইত্যাদি। তাই আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা আপনাদেরকে জানাতে যাচ্ছি ডিভোর্স কি এবংকিভাবে কোর্টের মাধ্যমে ডিভোর্স দেওয়া যায় ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে।
ডিভোর্স কি?
ডিভোর্স বা বিবাহ বিচ্ছেদ হল একটি বিবাহ বা বৈবাহিক মিলন বন্ধ করার প্রক্রিয়া। বিবাহ বিচ্ছেদ সাধারণত বিবাহের আইনি কর্তব্য এবং দায়িত্ব বাতিল বা পূর্ণগঠনকে অন্তর্ভুক্ত করে এইভাবে নির্দিষ্ট দেশ বা রাষ্ট্রের আইনের শাসনের অধীনে বিবাহিত দম্পতির মধ্যে বিবাহ বন্ধনের বন্ধন দ্রবীভূত করে। বিবাহ বিচ্ছেদের আইন বিশ্বজুড়ে যথেষ্ট পরিবর্তিত হয়।
ডিভোর্সের ধরন সমূহঃ
বাংলাদেশের ডিভোর্সের কয়েকটি ধরন রয়েছে। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো-
তালাক-এ-আহসানঃ
প্রক্রিয়াঃ স্বামী একবার তালা প্রদান করেন এবং স্ত্রী তিন মাসের অপেক্ষাকাল (ইদ্দত) পালন করেন।
বৈধতাঃ ইদ্দতের সময়ে স্বামী-স্ত্রী পুনরায় মিলত না হলে তালাক কার্যকর হয়। এটি সবচেয়ে মানবিক ও সহনশীল পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত।
তালাক-এ-হাসানঃ
প্রক্রিয়াঃ স্বামী তিন মাসে তিনবার তালাক প্রদান করেন, প্রতি মাসে একবার করে।
বৈধতাঃ তৃতীয় তালাক প্রদান করার পর, ইদ্দতের সময় শেষ হলে তালা কার্যকর হয়।
তালাক-এ-বিদ'আতঃ
প্রক্রিয়াঃ স্বামী একসঙ্গে তিন বার তালাক প্রদান করেন।
বিতর্কঃ এটি অনেক ক্ষেত্রে বিতর্কিত এবং ইসলামী আইন অনুযায়ী ভিন্নমত রয়েছে। সোহাগ আলেম এটি অনুমোদন করেন না।
ডিভোর্সের প্রক্রিয়াঃ
তালাকে প্রক্রিয়া বিভিন্ন ধাপের সম্পন্ন হয়। নিম্নে সেগুলো দেওয়া হলো-
নোটিশ প্রদানঃ
- স্বামী বা স্ত্রীকে লিখিত নোটিশ প্রদান করতে হয়, যেখানে তালাকের ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়।
- এই নোটিশটি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানের কাছে জমা দিতে হয়।
সমন্বয় সভাঃ
- নোটিশ প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান একটি সমন্বয় সভার ব্যবস্থা করেন।
- উভয় পক্ষকে এই সভায় উপস্থিত হতে হয় এবং উভয় পক্ষের মধ্যে সমন্বয় করার চেষ্টা করেন।
ইদ্দত পালনঃ
- যদি সমন্বয় সবার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান না হয়, তবে স্ত্রীকে তিন মাসের ইদ্দত পালন করতে হয়।
- ইদ্দতের সময় পুনরায় মিলিত না হলে তালাক কার্যকর হয়।
তালাকে রেজিস্ট্রেশনঃ
তালাক কার্যকর হলে স্থানীয় রেজিস্টারের কার্যালয়ে তালাক নিবন্ধন করতে হয়। এটি আইনের প্রক্রিয়ার অংশ এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহবিচ্ছেদ সম্পন্ন করতে প্রয়োজনীয়।
কয় ভাবে ডিভোর্স দেওয়া যায়ঃ
ডিভোর্স সাধারণত তিনভাবে দেওয়া যায়। যথাঃ
- উভয়ের পারস্পরিক সম্মতিতে তালাক।
- সরাসরি কাজীর মাধ্যমে তালা।
- কোর্টের মাধ্যমে তালাক।
উভয়ের পারস্পরিক সম্মতিতে তালাকঃ স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পারস্পরিক সম্মতিতে যদি তালাকের সিদ্ধান্ত হয় তাহলে উভয় পক্ষের লোকজন মিলে একটি সালিশি বৈঠক বসবে। একই বৈঠকের স্বামী- স্ত্রীর সমঝোতার ভিত্তিতে স্ত্রীর প্রাপ্য দেনমোহর প্রদান ও ভরণপোষণ প্রদান পূর্বক তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ করে তা কাজীর মাধ্যমে রেজিস্ট্রি করতে হবে।
এক্ষেত্রে কোনো নোটিশের প্রয়োজন নেই। তবে এই চালাকের পর আগের স্ত্রীকে বিবাহ করতে চাইলে তাকে ইদ্দতকালীন তিন মাস সময় অতিবাহিত করতে হবে। তিন মাস বা ৯০ দিন পরেই স্ত্রী বিবাহ করতে পারবেন। কাজী নির্ধারিত ফি নিয়ে তালাক রেজিস্ট্রি করবেন এবং ফ্রি ব্যতীত প্রত্যয়িত কপি প্রদান করবেন।
সরাসরি কাজের মাধ্যমে তালাকঃ উভয় পক্ষ যদি তালাক দিতে সম্মতি প্রকাশ করে, তাহলে তারা সরাসরি কাজী অফিসে গিয়ে কাজের মাধ্যমে তালাক প্রক্রিয়া কার্যকর করতে পারবেন। এক্ষেত্রে তালাক ৯০ দিনের পর কার্যকর হবে। আর এই ৯০ দিন বা তিন মাসের ভরণপোষণ স্ত্রীকে স্বামীর দিতে হবে।
কোর্টের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার নিয়মঃ
মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার জন্য আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে নিকাহনামার ১৮ নম্বর দফায় বা কলামে স্ত্রীকে তালাক বা ডিভোর্স দেওয়ার অধিকার না দিলে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য স্ত্রীকে আদালতে আবেদন করতে হয়।
১৯৩৯ সোনার মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদের আইন অনুযায়ী স্ত্রী তার স্বামীকে ডিভোর্স দিতে আদালতের কাছে আবেদন করতে হবে। আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত যাচাই-বাছাই করে আদেশ জারি করবেন। আদালতের আবেদনের সাত দিনের মধ্যে আদেশের সত্যায়িত কপি আদালত তার নিজস্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার চেয়ারম্যান বা মেয়রের ঠিকানায় পাঠাবেন।
চেয়ারম্যান বা মেয়র যেদিন নোটিশ পাবেন, সেদিন থেকে ঠিক ৯০ দিন পর তালাক চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবে। চেয়ারম্যান বা মেয়র সাহেব আদালতের আদেশের নোটির হাতে পাওয়ার পর ৩০ দিনের মধ্যে উভয়পক্ষকে নিয়ে একটি সালিশি বৈঠক মীমাংসা করার চেষ্টা করবেন।
যদি ৯০ দিনের মধ্যে তারা পুনরায় সংসারে ফিরে যেতে চান তাহলে যেতে পারবে। আর যদি চেয়ারম্যান বা মেয়র সাহেব উভয় পক্ষকে মিলাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ৯০ দিন পরেই তালাক চূড়ান্ত ভাবে কার্যকর হয়ে যাবে।
তালাক বা ডিভোর্সের খরচঃ
মুসলিম বিবাহ ও তালাক বিধিমালা ২০০৯-এর ২১ বিধি অনুযায়ী তালাক নিবন্ধনের জন্য ৫০০ টাকা ফি গ্রহণ করতে পারবেন রেজিস্টার। নকল প্রাপ্তি ফি ৫০ টাকা, যাতায়াত বাবদ প্রতি কিলোমিটার ফি ১০ টাকা ও তল্লাশি ফি ১০ টাকা গ্রহণ করতে পারবেন। আর এই তালাকের ফি তাকে পরিশোধ করতে হবে, যার পক্ষ থেকে তালাকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
তালাকের পরবর্তী পদক্ষেপঃ
তালাক বা ডিভোর্সের পর পরে উভয়পক্ষের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ রয়েছে:
মোহরানাঃ
ইফতার পাওনা মহরানা প্রদান করতে হবে। এটি ইসলামের শরিয়াহ অনুযায়ী স্ত্রীর অধিকার।
সম্পত্তির ভাগাভাগিঃ
বিবাহিত জীবনে যৌথ সম্পত্তি যদি থাকে তবে তা ভাগাভাগি করতে হবে। তবে এটি স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সম্মতির ভিত্তিতে করা উচিত।
সন্তানদের প্রতিপালনঃ
সন্তানদের প্রতিপালন এবং হেফাজতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সন্তানদের সর্বোচ্চ স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে।
স্ত্রী অন্তঃসত্তা থাকলেঃ
তালাক ঘোষণার সময় স্ত্রী যদি অন্তঃসত্তা থাকেন, সেক্ষেত্রে নিয়ম একটু ভিন্নতর। তালাকের নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন পরও যদি স্ত্রী অন্তঃসত্তা থাকেন, তাহলে যেদিন সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে, সেদিন তালাক কার্যকর হবে।
এর আগে নয়। কিন্তু নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন আগে যদি সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, তবে স্বাভাবিক নিয়মে, অর্থাৎ ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হবে।
ডিভোর্সের কতদিন পর বিয়ে করা যায়ঃ
আইনগত সব প্রক্রিয়া মেনে একতরফা অথবা দুই পক্ষের সম্মতিতে ডিভোর্স সম্পন্ন হওয়ার পর যেকোনো দিন পুনরায় বিয়ে করা যায়। তবে নারীদের ক্ষেত্রে খুলা তালাক সম্পন্ন হল পুনরায় বিয়ে করার আগে তিন মাস অপেক্ষা করতে হবে।
হিন্দু ধর্মালম্বীদের ডিভোর্সঃ
হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদের কোন বিধান নেই। দাম্পত্য সম্পর্ক তিক্ত পর্যায়ে গেলে একজন হিন্দু স্ত্রী তার স্বামী থেকে পৃথক ভরণপোষণ এবং পৃথক বাসস্থান দাবি করে মামলা করতে পারেন। তবে বর্তমানে আমাদের দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনেকেই দেওয়ানি আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদ চেয়ে ঘোষণামূলক মামলা করে থাকেন।
খ্রিষ্টধর্মালম্বীদের ডিভোর্সঃ
খ্রিষ্টান দম্পতি ডিভোর্স দিতে চাইলে জেলা জজ অথবা হাইকোর্ট বিভাগে আবেদন করতে হয়।দ্য ডিভোর্স অ্যাক্ট, ১৮৬৯ -এর ধারা ১৭ ও ২০-এর অধীন বিবাহবিচ্ছেদ ও বাতিল-সম্পর্কিত রায় হাইকোর্ট বিভাগের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হয়, যা অনেক বিচারপ্রার্থীর জন্য ঝামেলাপূর্ণ।
আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়া জটিল বলে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকে অ্যাফিডেভিট করে বিবাহবিচ্ছেদ ও আবার বিয়ে করে থাকেন। তবে এটা আইনসিদ্ধ নয়।
ভিন্ন ধর্মালম্বীদের মধ্যে ডিভোর্সঃ
বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ে হলে স্বামী বা স্ত্রী চাইলে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারবেন না।এ আইন অনুযায়ী কোন পক্ষ বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে চাইলে তাকে ১৮৬৯ সালের ডিভোর্স অ্যাক্ট অনুযায়ী এ বিচ্ছেদ ঘটাতে হবে। এর জন্য আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে এবং আদালতের অনুমতিক্রমে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে হবে।
বিবাহ বিচ্ছেদের নামে একটি হলফনামা পাঠিয়ে দিলেই বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যাবে, সেটি বলা যাবে না। আদালতের অনুমতি ছাড়া বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পন্ন করতে চাইলে অপরপক্ষ তা চ্যালেঞ্জ করতে পারবে।
শেষ কথাঃ
ডিভোর্স ইসলামের দিক দিয়ে একটি নিকৃষ্ট কাজ। সংসারে নানা ধরনের জটিলতা থাকতেই পারে কিন্তু আমাদের হুট করে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক না। কারণ এই ডিভোর্স বাচ্চাকাচ্চার জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাই ডিভোর্স নেওয়ার আগে অবশ্যই এ বিষয়গুলো মাথায় রাখা উচিত।
তাছাড়া আমার পক্ষ থেকে আমি ডিভোর্সকে কখনোই সমর্থন করি না। এজন্য আপনাদের সুবিধার্থে উক্ত আর্টিকেলে ডিভোর্স কি এবং কোর্টের মাধ্যমে মাধ্যমে কিভাবে ডিভোর্স দেওয়া যায় সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়ে আপনারা অনেক কিছু জানতে পেরেছেন এবং উপকৃত হয়েছেন।
আর আর্টিকেলটি পড়ে যদি আপনারা উপকৃত হয়ে থাকেন তাহলে আপনাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করবেন। এরকম জানা-অজানা তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটটি ভিজিট করবেন।
সাফান বিডির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url