সরিষার পুষ্টিগুণ এবং সরিষার তেলের উপকারিতা ও অপকারিতা জানুন
রসুন ও সরিষার তেলের উপকারিতানিশ্চয়ই সরিষার তেলের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিগুণ এবং উপকারিতা ও অপকারিতা রয়েছে আমরা অনেকেই এ বিষয়ে জানি আবার অনেকে জানিনা। তাই আজকের আর্টিকেলে এই বিষয়টা নিয়ে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করতে যাচ্ছি। আর আর্টিকেলটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়লেই সরিষার তেল সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
নিচে আর্টিকেলে আমরা সরিষার তেলের পুষ্টিগুণ, সরিষার তেলের ব্যবহার এবং সরিষার তেলের উপকারিতা ও অপকারিতাসহ বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
ভূমিকাঃ
সরিষার তেল গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিত। গ্রাম অঞ্চলের প্রতিটি বাড়িতেই কমবেশি সরিষার তেল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সরিষার তেল আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী একটি তেল। আর সরিষার তেল সহজলভ্য যে কেউ খুব সহজেই একে পেতে পারে।
তাই সরিষার তেল সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে জানতে হলে সরিষার তেলের পুষ্টিগুণ এবং সরিষার তেলের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে জানতে হবে। তাই আজকে আর্টিকেলে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
সরিষার তেলের পুষ্টিগুণ
সরিষার তেলে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান রয়েছে। যা বিশেষ করে আমাদের ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। সরিষার তেলের মধ্যে রয়েছে প্রোটিন, ভিটামিন ই, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড এবং পরিমাণমতো ভিটামিন এ।
এছাড়া এতে প্রচুর পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন আছে যা নতুন চুল গজাতে ও চুলের গোড়া মজবুত অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
সরিষার তেলের ব্যবহারঃ
সরিষার তেল খাওয়ার বেশকিছু স্বাস্থ্যকর নিয়ম রয়েছে। সরিষার তেলে রয়েছে উচ্চমানের ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অন্যান্য পুষ্টিগুণ থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তবে এটি ব্যবহারের বেশ কিছু নিয়ম রয়েছে। নিম্নে সেগুলো দেওয়া হল-
পরিমিত পরিমাণে ব্যবহারঃ সরিষার তেলে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে। যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু অতিরিক্ত তেল খেলে ওজন বাড়তে পারে, তাই পরিমিত পরিমাণে তেল খাওয়া উচিত।
রান্নায় ব্যবহারঃ সরিষার তেল সাধারণত নিম্ন এবং মাঝারি তাপমাত্রায় রান্নার জন্য উপযুক্ত। এটি বিশেষ করে ভাঁজা, বেকড বা সাঁতলানো খাবারের জন্য ভালো। তবে অত্যন্ত উচ্চতাপে (যেমন: ডিপ ফ্রাই এর জন্য) সরিষার তেল ব্যবহার না করাই ভালো, কারণ এতে তেলের গুণাগুণ কমে যেতে পারে।
কাঁচা সরিষার তেল খাওয়াঃ কাঁচা সরিষার তেল অনেক খাবারে (যেমন: সালাদ, আচার) ব্যবহার করা যায়। এটি খাবারের স্বাদ বাড়ায় এবং শরীরের জন্য উপকারী ফ্যাটি অ্যাসিড সরবরাহ করে।
নিয়মিত পরিবর্তনঃ সরিষার তেল খাওয়া ভালো, তবে এক ধরনের তেল নিয়ে নিতে ব্যবহার না করে মাঝে মাঝে অন্যান্য তেল যেমন: অলিভ অয়েল, সয়াবিন তেল, সূর্যমুখীর তেল ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন। এতে শরীর সব ধরনের পুষ্টিগুণ পাবে। ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ কমে যেতে পারে।
অতিরিক্ত প্রসেসড তেল পরিহারঃ খাঁটি সরিষার তেল বেছে নিন। কারণ অতিরিক্ত প্রসেসড বা পরিশোধিত তেলে স্বাস্থ্যকর
খাঁটি সরিষার তেল চেনার উপায়ঃ
খাঁটি সরিষার তেল বলতে সাধারণত আমরা বুঝি ঘানিতে ভাঙ্গা সরিষার তেলকে। যা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে কাঠের ঘানির মাধ্যমে সরিষাকে পিষ্ট করে তেল বের করা হয়। এই দেশীয় পদ্ধতিতে নিঃসরণকৃত সরিষার তেলের ঝাঁজ হয় কম, কিন্তু সুঘ্রাণ হয় বেশি।
অন্যদিকে ইলেকট্রিক কলে পিষ্ট হয়েও অনেকটা পুড়ে যে সরিষার তেল বের হয় সেই সরিষার তেল বাজারে বেশি পাওয়া যায়। আর এই তেলের সুঘ্রান কম হলেও ঝাঁজ থাকে অনেক বেশি। তাই খাঁটি তেলের স্বাদ ও উপকার পেতে খানিতে ভাঙ্গা খাঁটি সরিষার তেল ব্যবহার করুন।
সরিষার তেলের উপকারিতাঃ
সরিষার তেলের অনেক ধরনের উপকারিতা রয়েছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক সে উপকারিতা সমূহ-
ক্ষুধা বৃদ্ধি করেঃ আপনার ক্ষুধার উপর আপনার স্বাস্থ্য অনেকটা নির্ভর করে। পাকস্থলীর পাচক রস উদ্দীপিত করার মাধ্যমে ক্ষুধা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। যাদের ক্ষুধার সমস্যা আছে তারা রান্নার সময় সরিষার তেল ব্যবহার করতে পারেন।
হজম প্রক্রিয়াঃ সরিষার তেল হজম প্রক্রিয়াকে সাহায্য করে ও মেটাবলিক রেট বৃদ্ধি করে। যে কারণে হজম জনিত সমস্যা থেকে শুরু করে পেটের পীড়া ও গ্যাস্ট্রিক সমস্যা কমাতে সহায়তা করে।
ফুসফুস পরিষ্কার রাখেঃ সরিষার তেল এক ধরনের শ্বাসতন্ত্র পরিষ্কারক। কফ জনিত সমস্যায় সরিষার তেলের সাথে রসুন মিশিয়ে বুকে ও পিঠে লাগালে ভালো সমাধান পাওয়া যায়।
সরিষার তেল ব্যথা কমায়ঃ জয়েন্টের ব্যথা হাঁটুর ব্যথা আর্থাইটিস (বাত) সহ রিউম্যাটিকেট ব্যথাও দূর করে সরিষার তেল। তাছাড়া সরিষার তেলের মধ্যে প্রদাহ বিরোধী উপাদান থাকার কারণে এ ধরনের ব্যথা কমাতে খুবই কার্যকর।
ঠোঁট ফাটা রোধ করেঃ বিশেষ করে শীতকালে ঠোঁট ফাটা একটি খুব সাধারন সমস্যা। অনেকের মধ্যে এই সমস্যা এত বেশি যে এতে লিপবাম কাজ করে না। এর সমাধান হিসেবে আপনারা সামান্য সরিষার তেল নিয়ে ঠোঁটে লাগান। এই প্রাকৃতিক ময়শ্চারাইজার ঠোঁট ফাটা রোধ করে ঠোঁটকে নরম ও কোমল করে তুলে।
চুল পাকা রোধ করতেঃ সরিষার তেলে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদান ভিটামিন মিনারেল রয়েছে যা চুলের অকালপক্কতা সমস্যা রোধ করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সরিষার তেল আপনার চুলে ও মাথার তালুতে লাগান যা আপনার চুল পড়া রোধ করবে খুব তাড়াতাড়ি।
ত্বকের রুক্ষতা দূর করতেঃ অতিরিক্ত রুক্ষ ত্বক শীতের অন্যতম সমস্যা, যা আপনার সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বকে নষ্ট করে। তাই এ সমস্যার সমাধানে কয়েক ফোঁটা সরিষার তেল নিয়ে পুরো মুখে মালিশ করে নিন। কিছুক্ষণ রেখে পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিন। এটি ব্যবহারের পর মেকআপ বা ফাউন্ডেশন লাগানোর জন্য আপনার ত্বক পুরোপুরি রেডি।
ত্বকের তামাটে ভাব দূর করেঃ সরিষার তেল ত্বকের তামাটে ভাব ও দাগ দূর করে এবং ত্বককে প্রাকৃতিকভাবে উজ্জ্বল করতে পারে। এজন্য বেসন, দই, সরিষার তেল এবং কয়েক ফোঁটা লেবুর রস একত্রে মিশিয়ে মিশ্রণটি আপনার ত্বকে লাগান। ১০-১৫ পাঁচ মিনিট পরে ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। তাছাড়া ভালো ফল পেতে সপ্তাহে তিনবার ব্যবহার করতে পারেন।
উদ্দীপক হিসাবেঃ সরিষার তেল পরিপাক রক্ত সংবহন ও রেচনতন্ত্রের শক্তিশালী উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। এছাড়া খাওয়ার পাশাপাশি বাহ্যিকভাবে শরীরে মেসেজ করলে শরীরের রক্ত সঞ্চালন ও ঘর্ম গ্রন্থি উদ্দীপিত হয় এবং শরীরের তাপমাত্রা কমে।
হৃদপিন্ডের সুস্থ রাখেঃ সরিষার তেলে উপস্থিত ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, ওমেগা ৬ ফ্যাটি অ্যাসিড, মনোস্যাচুরেটেড পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে দারুন কার্যকর। সবসময় সরিষার তেল দিয়ে রান্না করা খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। এর পাশাপাশি ভর্তা বা সালাদে অল্প করে সরিষার তেল খাওয়া হৃদপিন্ডের জন্য উপকারী।
ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়ঃ গবেষণায় দেখা গেছে, সরিষার তেল ক্যান্সার কোষ কমাতে সাহায্য করে, এ কারণে রান্নায় সরিষার তেল ব্যবহার করুন। এছাড়ও এই তেল ব্যবহারে হাঁপানি, কাশি এবং দাঁতের ব্যথা থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়।
ভালো কোলেস্টেরল বৃদ্ধিতেঃ নিয়মিত সরিষার তেল খেলে এটি শরীরে ভালো কোলেস্টেরল বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
অ্যাজমা রোগেঃ অ্যাজমা অ্যাটাক সমস্যা হলে সরিষার তেল বুকে ঘষলে শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা বেড়ে যায়। এছাড়াও সরিষার তেল বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
চুল ও ত্বকের যত্নেঃ সরিষার তেলে ব্যাকটেরিয়া এবং ফাঙ্গাস বিরোধী গুণাগুণ ত্বক ও চুলকে উজ্জ্বল করে। বিশেষ করে শীতের সময় সরিষার তেল ত্বকে ব্যবহার করলে ত্বকের সুস্থতা শুষ্কতা দূর হয় এবং শরীর গরম থাকে। বিশেষ করে উচ্চ মাত্রার বিটা ক্যারোটিন থাকে এতে।বিটা ক্যারোটিন ভিটামে রূপান্তরিত হয়ে চুল বৃদ্ধি করে।
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগেঃ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে নাভিতে কয়েক ফোটা সরিষার তেল দিলে সুফল পাওয়া যায়। অনেক সময় পেটে ব্যথা অনুভব করলে সরিষার তেল মালিশ করলে আরাম পাওয়া যায়।
স্মরণশক্তি বৃদ্ধি ও চেতনার উন্নয়নঃ আপনার প্রতিদিনকার রান্নায় সরিষার তেল ব্যবহার করলে এর পুষ্টিগুণ স্মরণশক্তি বাড়াতে এবং চেতনার উন্নয়ন করতে সহায়তা করে
মাইগ্রেনের কষ্ট কমায়ঃ মাইগ্রেনের কষ্ট কমাতে ম্যাগনেসিয়াম দারুন কাজ করে। আর সরিষার তেলে প্রচুর পরিমাণ ম্যাগনেসিয়াম থাকায় এটি মাইগ্রেনের কষ্ট কমাতে সাহায্য করে।
সরিষার তেলের অপকারিতাঃ
সরিষার তেল স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী হলেও এর কিছু অপকারিতা বা ঝুঁকি রয়েছে, বিশেষ করে অতিরিক্ত বা অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে। নিম্নে সরিষার তেলের কিছু অপকারিতা আলোচনা করা হলো-
অ্যালার্জি বা ত্বকের সমস্যাঃ অনেকে আছে যারা সরিষার তেল খেলে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া হতে পারে। সরিষার তেল সরাসরি ত্বকে লাগালে বা খেলে কারো কারো ত্বকে ফুসকুড়ি, চুলকানি বা লাল হওয়ার মতো অ্যালার্জি হতে পারে।
অতিরিক্ত তাপের কারণে বিষাক্ততাঃ উচ্চতাপে সরিষার তেল গরম করলে বা ভাজার সময় এর উপাদান পরিবর্তিত হয়ে বিষাক্ত যৌগ তৈরি হতে পারে। সরিষা তেলের ধোঁয়া বিন্দু তুলনামূলকভাবে কম, তাই উচ্চ তাপে দীর্ঘক্ষণ রান্না করলে এর পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায় এবং তা ক্ষতিকর হতে পারে।
পেটের সমস্যাঃ কিছু লোকের সরিষার তেল খাওয়ার পর পেটে অস্বস্তি গ্যাস কিংবা বদহজমের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। যারা গ্যাস্ট্রিক বা হজমজনিত সমস্যায় ভুগছেন তাদের সরিষার তেলনিয়ন্ত্রিতভাবে খাওয়া উচিত।
শিশুদের জন্য ঝুঁকিঃ ছোট ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে সরিষার তেল সরাসরি খাওয়ানো বা ত্বকে লাগানো ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। কারণ তাদের সংবেদনশীল ত্বক বা শারীরিক গঠন সরিষার তেলের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।
রক্তচাপের সমস্যাঃ সরিষার তেলের কিছু উপাদান রক্তচাপের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। যারা উচ্চবা নিম্ন রক্তচাপে ভুগছেন, তাদের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সরিষার তেল অতিরিক্ত ব্যবহার করা নিরাপদ নয়।
পরিশেষেঃ
বিভিন্ন গুণের অধিকারী এই সরিষার তেল আমাদের জীবনে প্রতিদিনের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে থাকে। সরিষার তেলের বহুবিদ ব্যবহার রয়েছে আমাদের জীবনে। তাই আজকের আর্টিকেলে আমরা সরিষার তেলের পুষ্টিগুণ, ব্যবহার এবং উপকারিতা ও অপকারিতা সহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি।
আশা করি আর্টিকেলটি পড়ে আপনারা অনেক কিছু জানার পাশাপাশি উপকৃত হয়েছে। আর যদি উপকৃত হয়ে থাকেন তাহলে আর্টিকেলটি আপনাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করবেন। তাছাড়া এরকম নতুন নতুন কনটেন্ট সম্পর্কে জানতে আমাদের ওয়েবসাইটি ভিজিট করুন।
সাফান বিডির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url